সুখুর সিঙ্গারা খেলো কে?

0
57

সিঙ্গারা বাংলাদেশ তথা পুরো উপমহাদেশজুড়েই বিপুলভাবে জনপ্রিয়। সকালের নাস্তার রেশ শেষ হতে না হতেই খাবারের হোটেলগুলোয় দেখা মেলে লোভনীয় এই পদটির। ভারতেও তাই। সেজন্যই বোধহয় সেদেশের হিমাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী সুখবিন্দর সিংহ সুখুর জন্য আনানো সিঙ্গারা অন্য কেউ খেয়ে ফেলায় এখন সেটি নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে এটি নিয়ে বিতর্ক দেখা দিলে রণে ভঙ্গ দেন সুখু। জানান তদন্ত হচ্ছে না।

ভাবা যায় ব্যাপারটা? সিঙ্গারার প্রতি কারো কারো আগ্রহ কোন পর‌্যায়ে?

এটি গেল মাসের ঘটনা। মুখ্যমন্ত্রী গিয়েছিলেন সেখানকার সিআইডির সদর দফতরে সাইবার শাখা উদ্ধোধন করতে। মুখ্যমন্ত্রীর জন্য যে নাস্তার ব্যবস্থা করা হয় তাতেই ছিল এই সিঙ্গারা। সাথে আরো ছিল কেক। আনন্দবাজার পত্রিকার দেয়া তথ্য অনুযায়ী স্থানীয় এক বিলাসবহুল হোটেল থেকে সিঙ্গারা ও কেক আনানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই খাবার মুখ্যমন্ত্রীর পরিবর্তে তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মীদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। মুখ্যমন্ত্রীর জন্য আনানো সিঙ্গারা ও কেক প্রোটোকল মেনে তাঁর হাতে না পৌঁছানোয় এই তদন্তের নির্দেশ।

এই ঘটনাকে ‘সরকার-বিরোধী’ বলেও দাবি করা হয়েছে। ফলে বেড়াতে যাওয়া মানুষদের কাছে বিপুল আকর্ষনের কেন্দ্রে থাকা হিমাচলের রাজনীতি এখন সিঙ্গারার আলোচনায় সরগরম। পত্রিকার রিপোর্ট থেকে বোঝা যাচ্ছে মুলত সমন্বয়ের অভাব থেকেই এমনটা ঘটেছে। কিন্তু সিঙ্গারা যেহেতু মুখ্যমন্ত্রীর জন্য আনানো হয়, কাজেই এর তছরুপ তো মেনে নেয়া যায় না।  

মুখ্যমন্ত্রী সুখুর সিঙ্গারা বেহাত হওয়া নিয়ে এখন হিমাচলে রাজনৈতিক রসিকতার পাশাপাশি কটাক্ষও শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে পত্রিকাটি। আবার তার এই ‘অপূর্ণ রসনাতৃপ্তি’ নিয়ে কটাক্ষ করেছে বিজেপি। তাদের ভাষ্য সুখুর সরকার রাজ্যের উন্নয়নের কথা না ভেবে সিঙ্গারায় মজে রয়েছে। তা যে যাই বলুক। এ ঘটনায় আরো একবার সিঙ্গারার গুরুত্ব ফুটে উঠলো। ভারতের এক বিখ্যাত রাজনৈতিক লালু প্রসাদ যাদব তো বলেই দিয়েছিলেন যতদিন সিঙ্গারার ভেতরে আলু থাকবে ততদিন তিনিও তার রাজ্য বিহারে প্রাসঙ্গিক থাকবেন।

সিঙ্গারা এদেশেও খুব জনপ্রিয় নাস্তা। যত দামি অনুষ্ঠানই হোক, কিংবা হোক ধর্মীয় অনুষ্ঠান; অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সিঙ্গারা পরিবেশন করতে দেখা যায়। সবচেয়ে বড় কথা এটা একটা শ্রেণীহীন নাস্তার আইটেম। ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সবার কাছে এটি একটি লোভনীয় খাবার। এটা দেখলেই জিভে পানি এসে যায়। পুরো দেশ জুড়েই সকালের একটা নির্দিষ্ট সময়ে দোকানে দোকানে সিঙ্গারা থাকবেই।

কারো কারো মতে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা হলো সিঙ্গারা টাইম। গরম গরম তেলে ভাজার প্রতি এমনিতেই বাঙালির অনেক পছন্দ। সিঙ্গারা, সমুচা, চপ, ভেজিটেবল রোল ইত্যাদি সবই তেলে ভাজা। এরকম তেলে ভাজা নাস্তা দেখলে লোভ সামলানো কঠিন। তাছাড়া সব বয়সী মানুষের কাছেই সিঙ্গারা খুবই প্রিয় একটি খাবার। হালকা খাবার হিসেবে সিঙ্গারা সকল শ্রেণী পেশার মানুষের কাছেই জনপ্রিয়।

মুলত সকালেই এর দেখা মেলে বেশি। তবে হালে বিকালেও গরম গরম সিঙ্গারা ভাজতে দেখা যায়। দেশের অনেক জেলায় কিছু খাবার দোকান তো শুধু সিঙ্গারার জন্যই বিখ্যাত। আমরা যারা ঢাকায় বাস করি তাদের স্মৃতিতে থাকার কথা গুলিস্তানের স্টেডিয়াম পাড়ায় নবান্ন (অধুনা হোটেলটি বিলুপ্ত), শাহবাগের কোহিনুর ও শান্তিনগরের জলখাবার (এরাও এখন আর বানায় না) এর সিঙ্গারার কথা। অপরদিকে কোহিনুর এখনো সিঙ্গারা বানায়। তবে তাদের কলিজা সিঙ্গারা রসনা বিলাসিদের কাছে আর আগের মতো আবেদন তৈরি করতে পারে না।

এই সিঙ্গারারও আবার আছে দীর্ঘ ইতিহাস। প্রাপ্ত তথ্য মতে বাংলাদেশ ও ভারতের কোন কোন রাজ্যে এটি বিপুলভাবে জনপ্রিয় হলেও সিঙ্গারার জন্মস্থান উপমহাদেশের বাইরে । বলা হয়, ফার্সি শব্দ ‘সংবোসাগ’ থেকেই এই সিঙ্গারা শব্দের উৎপত্তি। মতান্তরে কোনও কোনও ইতিহাসবিদদের দাবি, গজনবী সাম্রাজ্যে সম্রাটের দরবারে এক ধরনের নোনতা পেস্ট্রি পরিবেশন করা হতো। যার মধ্যে কিমা, শুকনো বাদাম জাতীয় কিছু দেওয়া হতো।

ইতিহাসবিদদের মতে, ভারতে ২০০০ বছর আগে সিঙ্গারার আবির্ভাব। বাংলাদেশে আসার পর সিঙ্গারার অনেক পরিবর্তন হয়। এ অঞ্চলে এটিকে আরও সুস্বাদু করে তোলার জন্য সিঙ্গারার মধ্যে আলূ, মরিচ এবং কিছু মশলা ব্যবহার করা হয়। ১৬ শতকে পর্তুগিজরা বাংলা অঞ্চলে আলুর প্রচলনের পর সিঙ্গারার মধ্যে এটি দেয়ার রীতি চালু হয়। আবার অনেকে সিঙ্গারার মধ্যে কলিজাও দিয়ে থাকেন। মোটা দাগে আলুর পুর দেয়া সিঙ্গারার চলই বেশি।

যোগাযোগ মাধ্যম কোরায় পাওয়া তথ্য বলছে, পারস্যের কবি ইসহাক আল-মাওসিলির নবম শতাব্দীর একটি কবিতায় সমোসার প্রশংসনীয় পাওয়া যায়। আমির খুসরো (১২৫৩-১৩২৫), একজন আলেম এবং দিল্লি সুলতানাতের রাজকবি। তিনি প্রায় ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে লিখেছিলেন যে -রাজকুমারগণ ও আভিজাত্যরা “মাংস, ঘি, পেঁয়াজ ইত্যাদিতে প্রস্তুত সামোসা উপভোগ করেন।” এই সামোসা থেকেই সিঙ্গারার উৎপত্তি বলে মনে করেন। বাঙ্গাল মুলুকে সিঙ্গারায় আলু ঢুকে এটাকে আলাদা ব্যঞ্জন হিসেবে দাড় করিয়েছে বলে মনে করা হয়ে থাকে।


LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here