মেঘের পসরা বসেছে শীতের সাজেকে

0
53
sajek

লালন গুণে: শীতের সাজেকে ঘুরতে যাওয়া মানেই অন্যরকম এক অনুভূতি। চারদিকে সবুজ সবুজে মেশা নীল নীলিমা আর ঢেউ খেলানো পাহাডের সারি মিলিয়ে দেশের পূর্বাঞ্চলীয় জেলা রাঙ্গামাটির এই উপত্যকা। দিনের রোদে চলে মেঘ পাহাড়ের মেশামেশি। আলো ছায়ার খেলা। রাতে নামে মেঘেদের ঢল। মেঘেরা রাতে এসে পুরো সাজেক উপত্যকা জুড়ে যেন চাদর বিছিয়ে দেয়।

তাই এটা দেখতে খুব ভোরে ওঠার বিকল্প নেই। কেননা এরপর সকালের নরম রোদে মেঘদল ধীরে ধীরে উড়ে চলে যায়। উবে যেতে যেতেই ছড়িয়ে যায় নিসর্গের মোহনীয় পরশ। তার আগে সূর্যি মামার পূর্ব দিগন্তে আবির্ভাবও এক বর্ণিল রুপে সাজিয়ে তোলে সাজেককে। এসব দেখতেই তো ভীড় জমায় হাজারো পর‌্যটক। মাঝে কিছুদিন নিরাপত্তাজনিত পরিস্থিতির কারণে সাজেকে ভ্রমণার্থীদের যাওয়া বন্ধ থাকলেও সম্প্রতি সরকার আবার সেখানে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে।

এমনিতেই শীত মানে বেড়ানোর সময়। কাগজে কলমে এখনো শীত শুরু হয়নি। তবে সমতলভূমিতে এখনো গরমের প্রভাব পরিলক্ষিত হলেও সাজেক শীতার্ত হয়ে উঠছে। সাধারণ ভ্রমণার্থীদের কাছে শীতের সাজেকই বেশি জনপ্রিয়। বিশেষ করে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী সময়ে। তার মধ্যে আবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোয় পর‌্যটকদের ভীড় বেশি। অপরদিকে এডভেঞ্চারপ্রিয়রা অবশ্য বর্ষাকেই বেশি পছন্দ করেন। সে আরেক প্রসঙ্গ।শীতের সময়ে বিকেল পেরিয়ে পশ্চিমের আকাশ দিনের বিদায়ী সূর‌্য যখন পাহাড়ের কোলে হেলে পড়ে সেসময় এক ঐশ্বরিক সুখানুভূতি মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। বিশেষ করে যারা সেখানকার কংলাক পাহাড়ে ওঠেন। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ ফুট উপরে এই কংলাক। এভারেস্ট যাদের মনে দোলা দেয়, তারা এই কংলাকে উঠে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর অনুভূতি নিতে পারেন।তারপর নামে রাত। সাজেকের রাতও অন্যরকম। কেননা এ সময় চাঁদের আলোতে ভিন্ন এক রূপ ধারন করে উপত্যকাটি। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামতেই নৈর্সগিক নিরবতা পাহাড়ের চারপাশে। আকাশে তারাদের মেলা, শীতের হিম মাখা ঝিরি ঝিরি বাতাস নিজের অজান্তেই মনকে নিয়ে যাবে এক অপার্থিব জগতে। অগুনতি তারা আকাশের বিশাল বিস্তারে আপনার সামনে ধরা দেবে। নক্ষত্র আর মিল্কিওয়ে দেখার জন্যও সাজেকের আকাশ চমৎকার জায়গা।  এ সময় কেবল প্রকৃতিই থাকবে আপনার সামনে। এ এক অন্য রকম ভাললাগার অনুভূতি।শহুরে রাতে যারা অভ্যস্ত তাদের কাছে সৌন্ে র‌্যের নতুন ঢালা নিয়ে হাজির হবে সাজেকের আকাশ। এখন বিদ্যুতের আলো এলেও রাতের আকাশ তারপরও সমতল ভুমির চাইতে ভিন্ন আঙ্গিকে ধরা দেবে আপনার কাছে। আর পূর্ণিমার সময় বেছে নিতে পারলে তো কথাই নেই। রাতের দিগন্তে জোছনার আলো পুরো অরণ্য প্রকৃতির উপর পড়ে আবেশে জড়িয়ে দেবে যে কাউকে। রাতের আকাশেও দেখবেন মেঘেদের ক্লান্তিহীন উড়াউড়ি। রাত গভীর হলে হয়তো শুনতে পাবেন দুর থেকে ভেসে আসা অচেনা পাখিদের ডাকও। এর বাইরে প্রকৃতি প্রেমীরা পাহাড়ের ঢাকে গাছগাছালি আর জঙ্গলের মাঝের ছোট সরু পথ দিয়ে ট্রেকিং করার আনন্দ নিতে পারেন। পাহাড় থেকে নামতে তেমন কষ্ট না হলেও উঠতে অনেক বেগ পেতে হয়। তাই পানি নিতে হবে সাথে। প্রায় ৭০-৮০ ফুট নিচে একটা ঝর্নাও আছে সেখানে। শীতে ততটা জলধারা থাকে না। এছাড়া বিকেলে হ্যালিপ্যাডে ব্যাম্বু টি পাওয়া যায়। মূলত তেঁতুল দিয়ে তৈরি চা সাইজ করা ছোট বাঁশের আধারে পরিবেশন করা হয় বলেই এই নাম। তাছাড়া আছে হরেক রকমের ঝাল মিষ্টি পিঠা কিংবা ভাজা পোড়া সামগ্রি।উত্তরে দক্ষিণে আড়াআড়ি দুই আড়াই কিলোমিটারের এক সিমেন্ট বাধানো রাস্তার পাশেই সাজানো হয়েছে পর‌্যটন কেন্দ্রটি। রুইলুই পাড়া দিয়ে ঢোকার মুখেই শুরু হয় হোটেলের সারি। ২০১৫ সালে এটি চালু হওয়ার পর প্রথমদিকে রাস্তার দুই ধারে এত হোটেল ছিল না। তখন দুরের প্রকৃতি ছাড়াও সাজেকের উপরের উপত্যকাটাও ছিল দেখার মতো। এখন অবশ্য নতুন করে আর কোন হোটেল মোটেল কিংবা রিসোর্ট করতে দেয়া হয় না। এখন যারা বেড়াতে বেরোন তাদের কাছে সাজেক অন্যতম সেরা পছন্দ। মুলত সাজেক বলতে যে স্থানকে বুঝায় সেটি ‘রুইলুই’ এবং ‘কংলাক’ নামের দুটি বসতিকে ঘিরে বানানো।  বিচ্ছিন্ন ভাবে কমলা ও কফি চাষের জন্য বিখ্যাত সাজেক। রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার একটা ইউনিয়ন হলেও সাজেক যেতে হয় খাগড়াছড়ি হয়ে। রাঙামাটির সর্বউত্তরের মিজোরাম সীমান্তে অবস্থিত এই বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্রটি। এর উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা, দক্ষিণে রাঙামাটির লংগদু, পূর্বে ভারতের মিজোরাম, পশ্চিমে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা অবস্থিত।

কিভাবে যাবেন: সাজেক প্রশাসনিকভাবে রাঙ্গামাটিতে হলেও যাওয়া আসার সুবিধা খাগড়াছড়ি হয়ে। ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে দেশের প্রসিদ্ধ সব কোম্পানির এসি/ননএসি বাসে খাগড়াছড়ি যেতে হবে আগে। এরপর খাগড়াছড়ির শাপলা চত্বর থেকে ‘চান্দের গাড়ি’তে করে রিজার্ভ বা দল জোগাড় করে সরাসরি সাজেক যেতে হয়। চান্দের গাড়ি ছাড়াও সিএনজি ও মোটর সাইকেলে সাজেক যাওয়া যায়। এগুলোকে অবশ্য সকাল ১০টা ও বিকেল ৩ টায় দুই দফায় সামরিক বাহিনীর পাহারায় সাজেকে নিয়ে যাওয়া হয়।

রাঙ্গামাটি থেকেও নৌপথে লঞ্চযোগে অথবা সড়কপথে বাঘাইছড়ি হয়ে সাজেক যাওয়া যায়। রাঙ্গামাটির রিজার্ভ বাজার লঞ্চঘাট থেকে প্রতিদিন সকালে লঞ্চ ছাড়ে। সময় লাগে ৫-৬ ঘন্টা। বাসে সময় লাগে ৬-৭ ঘন্টা।ভ্রমণ পরিকল্পনার আগে অনলাইনে কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে ঘুরে আসা কারো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আপনার জন্য সবচাইতে কাজের হতে পারে। থাকার স্থান নির্ধারনেও তাই। কেননা সেখানে ইকোনমি থেকে ব্যয়বহুল সবধরণের হোটেল রিসোর্ট আছে।

সবমিলিয়ে শুভ হোক আপনার সাজেক ভ্রমণ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here