কেন ইলিশ অধরা
বুদ্ধদেব বসু মাছটিকে ভালবাসা থেকে বলেছিলেন জলের উজ্জ্বল শষ্য। আর বাঙ্গালির কাছে ইলিশ বিরাট এক আবেগের ব্যাপারে। তাই তারা এ মাছটি দিয়ে কত রকমের ব্যঞ্জন যে তৈরি করে, বলে শেষ করা যাবে না। সর্ষে ইলিশ, ভাপা ইলিশ, পাতুরি, ইলিশ পোলাও জনপ্রিয় পদগুলোর অন্যতম।
ইলিশ আবার বাংলাদেশের জাতীয় মাছও। দেশের ঐতিহ্য। ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই এ মাছটার ভাগ পেতে চায়। শুধু এদেশের ভোজনরসিকরাই নয়, দুর্গাপুজার প্রাক্কালে বাংলাদেশের ইলিশটাই পাতে তুলতে চায় ওপার বাংলার মানুষরাও।
কিন্তু কয়েক বছর ধরেই মাছের রাজা ইলিশ সাধারণ মানুষের নাগালে নেই। এমনকি মাছটির বংশায়নের জন্য চালু করা নিষেধাজ্ঞাও এর উৎপাদন বাড়াতে পারছে না।
ফলে চাহিদার সাথে জোগান মিলছে না বলে কয়েক বছর ধরেই ইলিশ বাঙালির পাত থেকে উধাও। অথচ সরকারী হিসাব বলছে মাছটির উৎপাদন নাকি বেড়েছে। সরকারী পরিসংখ্যান বলে বছরে সাড়ে পাচ লাখ থেকে ছয় লাখ টন ইলিশ বাজারে আসে। এর সাথে জড়িত পাচ লাখ জেলে। তাদের পরিবার পরিজন ও ইলিশের সাথে সংশ্লিষ্টদের ধরলে আরো ২০ লাখ মানুষ এর সাথে জড়িত।
প্রাসঙ্গিক
বাজার অবশ্য তেমনটা প্রমাণ দেয় না। কারণ বেশি মাছ ধরা পড়লে ঝাকে ঝাকে ইলিশ ধরা পড়ার খবর আসতো গণমাধ্যমে। নগরের মহল্লাগুলোয় ফেরিওয়ালারা হাকডাকে টেকা দায় ছিল। ঢাকা, চাদপুর ও বরিশালের আড়তগুলো সয়লাব হয়ে যেত ইলিশে। দিনকয়েক আগে ঢাকার যাত্রাবাড়ি ও চাদপুরে গিয়েও দেখলাম মাছ আছে বটে, তবে পরিমাণে অনেক কম।
তাহলে এর কারণ কি? এখানেই বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো। মুলত যে কটি সমস্যার কারণে ইলিশ যথেষ্ট পরিমাণে মিলছে না, তার অন্যতম হলো সরকারের দেয়া নিষেধাজ্ঞা। অপর কারণগুলোর মধ্যে আছে ভারতসহ পশ্চিমের দেশগুলোয় রপ্তানি কিংবা জেলেদের দেয়া তথ্যমতে সাগর থেকে বড় মাছ পাচার হয়ে যাওয়া।
ইতোমধ্যে শনিবার (১২ অক্টোবর, ২০২৪) থেকে ২২ দিনের জন্য ইলিশ ধরার উপরে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এটি শেষ হবে ৩ নভেম্বর ২০২৪। এর অন্যতম উদ্দেশ্য মেঘনা ও পদ্মায় মিঠা পানিতে যেন মাছ ডিম ছাড়তে পারে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন।
সরকার বছরে যে দুবার (একটি সাগরে) ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞা দেয় সেটি আসলে কয়েক বছর ধরে কাজে আসছে না। প্রথমত ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞার সময় সরকার জেলেদের ২০/২২ কেজি চাল দেয়। এটি পরিবার পরিজন নিয়ে জীবন ধারণের জন্য যথেষ্ঠ নয়।
খালি চাল খেয়ে তো আর জেলেদের পক্ষে বেচে থাকা সম্ভব নয়। এর সাথে তেল, নুন, ডাল, আলু কিংবা আনাজের ব্যবস্থা নেই। তখন বাধ্য হয়েই জেলেরা গোপনে নদীতে নামে। দালালের মাধ্যমে সরকারী পাহারাদারদের কোন একটি অংশের সাথে সমঝোতা হয়।
অতি সম্প্রতি চাদপুরের ‘নামায়’ মানে নীচের দিকে জেলেদের মাছ ধরা দেখতে গিয়ে এসব তথ্য জানতে পারি। নিশুতি রাতে মাছ ধরার ফাকে অনেক কথার মধ্যে কামরুজ্জামান নামের এক নৌপুলিশের কথা জানতে পারি। যিনি কিনা চাদপুরে দায়িত্বে থাকার সময় এই ব্যবস্থায় প্রচুর অর্থ কামাতেন। জেলেদের এ ব্যবস্থা যারা করেন, তাদের একজনও ছিলেন আমাদের সাথে। তার মতে এই কর্মকর্তা নাকি কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন শুধু মেঘনা অববাহিকার জলে।
নিষেধাজ্ঞার সময়ে ইলিশের বিচরন নির্বিঘ্ন করা না গেলে মাছটির উৎপাদন বাড়বে না। আর এই চোরা ব্যবস্থার ফাক গলে কিছু ইলিশ প্রজনন করতে পারলেও মাছগুলো বড় হওয়ার আগেই জালে আটকা পড়ে যাবে।
গত কয়েক বছরে যে বড় ইলিশের যে দেখা মিলছে কম, তার অন্যতম কারণ হতে পারে এটি। বাঙ্গালির পছন্দ এক কেজি বা তার উপরের ইলিশ। তার জন্য যে পরিমাণ সময় দরকার তা আর যাই হোক নদীতে মিলছে না।
এ কারণেই এখন পদ্মা তো দুরের কথা, মেঘনাতেই এক কেজি সাইজের ইলিশের দেখা মিলছে না। কালে ভদ্রে মিললেও সেগুলোর পরিমাণ খুবই কম। মেঘনার ওই জেলেরা বলেছিল কেবল ভাগ্য অতি সুপ্রসন্ন হলেই দুই চারটি বড় ইলিশ তাদের জালে ধরা দেয়।
ঢাকার যাত্রাবাড়ি মোকামে কিংবা চাদপুরের বড় স্টেশন বাজার ঘাটে মাছ কিনতে গিয়ে এক কেজির যেসব ইলিশের দেখা মিলে সেগুলো মুলত সাগরের। কিংবা সাগর সংলগ্ন নদীর মোহনায় পাওয়া। কিন্তু ব্যবসায়ীরা পটুয়াখালির রাঙ্গাবালি উপজেলার সর্বদক্ষিণের চর মন্তাজের মাছকেও পদ্মার ইলিশ বলে চালিয়ে দিচ্ছে। অথচ মেঘনাতেই বড় ইলিশ নেই, পদ্মায় তো পাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
মেঘনা কিংবা মেঘনা ঠেলে পদ্মায় যে ইলিশ আসতে পারছে না, তার অন্যতম কারণ ঢাকার চারপাশের শিল্প কারখানা থেকে ফ্রিস্টাইল ছেড়ে যাওয়া বর্জ পানি। বর্ষার বাইরে ঢাকার চারিদিকের নদীগুলো দিয়ে যে বর্জ পানি নেমে মেঘনায় পড়ছে, সেগুলো কোনভাবেই ইলিশের তো নয়ই, অন্য মাছেরও বসবাসের উপযোগী নয়।
কাজেই সাগরে ইলিশ মিললেও নদীতে তা অধরাই থেকে যাবে। শুধু তাই নয়, একসময় যদি বাংলাদেশের উপকুল থেকেও ইলিশ হাওয়া হয়ে যায় অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। যেমনটা হয়েছিল চিলির উপকুলে হেক মাছের ক্ষেত্রে। ওই হেক মাছ চিলির উপকুল ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
তাহলে মাছটা চলে যাওয়ার আগে তাকে ধরে রাখতে উপযুক্ত পরিবেশের ব্যবস্থা করি।