ঢাকা, ১৪ জানুয়ারী ২০২৪: সাকরাইন মূলত পুরান ঢাকার জনপ্রিয় এক উৎসব। পৌষসংক্রান্তির দিনে ঘুড়ি উড়ানোকে ঘিরেই মুলত এ উৎসব ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনায় উদযাপিত হয়ে থাকে। এবারও তাই হচ্ছে। যদিও ঘন কুয়াশা এ আনন্দ উৎসবে কিছুটা বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। কারণ কুয়াশার কারণে সাকরাইনের অন্যতম আকর্ষণ রং বেরংয়ের ঘুড়ি ওড়ানোটা ঠিক জমেনি এদিন।
বলা হয়ে থাকে এটি বাংলাদেশের প্রাচীন উৎসব সমূহের মধ্যে একটি। যদিও এ উৎসব ঢাকার আদি অংশেই সীমাবদ্ধ বেশি। তাই অনেকের চোখে এটি ঢাকাইয়া উৎসবও যা পালিত হয়ে থাকে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে। ঘুড়ি ওড়ানো, সন্ধ্যার পর আতশবাজির রোশনাই, ডিজে পার্টির সাথে চলে দিনভর ব্যাপক খাওয়া দাওয়াও।
পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়া, লক্ষ্মীবাজার, শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, গোয়ালনগর, লালবাগ ও এর আশেপাশের এলাকাগুলোয় বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় সকল বয়সীরা মেতে ওঠে এ উৎসবে। সকাল থেকে শুরু করে দিনভর এই সব এলাকায় আকাশে রং বেরংয়ের ঘুড়ি ওড়ে। এক সময় রাস্তায় দাঁড়িয়েও লোকজন ঘুড়ি ওড়াতো। তবে এখন মুলত ছাদে দাঁড়িয়ে ঘুড়ি ওড়ানো হয়। আর অধিকাংশ সময়েই চলে ঘুড়ি কাটাকাটির প্রতিযোগিতা। এরপর সন্ধ্যায় বর্ণিল আতশবাজি ও রংবেরংয়ের ফানুশে ছেয়ে যায় এ শহরের বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী অংশটির আকাশ।
সংস্কৃত শব্দ ‘সংক্রান্তি’ ঢাকাইয়া উচ্চারনে সাকরাইন রূপ নিয়েছে। পৌষ মাসের শেষদিন সারা ভারতবর্ষে সংক্রান্তি হিসাবে উদযাপিত হয়। বাংলা বর্ষপঞ্জিকার নবম মাস পৌষের শেষ দিনে আয়োজিত হয় এটি। ইংরেজি বর্ষপঞ্জিকার হিসেবে জানুয়ারি মাসের ১৪ কিংবা ১৫ তারিখে পড়ে সাকরাইন উৎসব।
ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার এক নিবন্ধে উল্লেখ করা হয় সংক্রান্তি বা মকরসংক্রান্তি একটা ফসলী উৎসব। এটি শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় পালিত হয়। ভারতেও এই উৎসব সাধারণত ১৪ জানুয়ারি বা তার এক দিন আগে পরে পালিত হয়। ভারতের পশ্চিম বঙ্গে এটিকে পৌষ সংক্রান্তি, তামিলনাড়ুতে পোঙ্গল, গুজরাতে উত্তরায়ণ, অসমে ভোগালি বিহু, কর্নাটকে মকর সংক্রমণ, কাশ্মীরে শায়েন-ক্রাত, নামে এই উৎসব পালন করা হয়।
এ উৎসবকে উপলক্ষ্য করে পুরান ঢাকায় ঘুড়ি, নাটাই ও সুতা বেচাকেনার ধুম পড়ে। জানা গেছে অন্যান্য বছরের মতো এবারো বেচাকেনা ভালোই চলেছে। গণমাধ্যমের প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো থেকে জানা যাচ্ছে প্রতিবছরের মতো এবারও হরেক রকমের ঘুড়ির বেচাকেনা চলছে পুরান ঢাকার দোকানগুলোয়।
এসব ঘুড়ির নামও অনেক বাহারি। এই যেমন চশমাদার, কাউটাদার, পঙ্খিরাজ, প্রজাপতি, চক্ষুদার, বোয়াদার, পান, চ্যাপলা, নৌকা, ঈগল, সাদা ঘুড়ি, চারবোয়া, দুই বোয়া, টেক্কা, লাভ ঘুড়ি, মালাদার, দাবা ঘুড়ি, বাদুর, চিল, অ্যাংরি বার্ডসহ নানা নামের ঘুড়ি বিক্রি হচ্ছে দোকানগুলোয়। সঙ্গে বিক্রি হচ্ছে ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য সুতা ও নাটাই।
এসব ঘুড়ির দামও নানান রকমের। সাধারণ ঘুড়ি প্রতিটি বিক্রি হচ্ছে ৫ টাকা থেকে ৫০ টাকায়। বিদেশি ও নকশা করা ঘুড়ির দাম প্রতিটি ১৫০ থেকে ৩৫০ টাকাযর মধ্যে। নাটাই প্রকারভেদে ১৫০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মাঞ্জা দেওয়া সুতা মান অনুযায়ী ৬০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সাকরাইনে দিনব্যাপী ঘুড়ি উড়ানো শেষে পুরান ঢাকার অলিতে-গলিতে, বাসাবাড়ির ছাদে ডিজেপার্টি, নাইটপার্টি আয়োজনের প্রচলন দেখা যাচ্ছে। গানের তালে তালে নাচে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে তরুণ-তরুণীরা। এর জন্য প্রস্তুতিও চলতে থাকে কয়েকদিন আগ থেকে। ছাদে মঞ্চ সাজিয়ে বিশালাকৃতির সাউন্ড বক্স বাজিয়ে চলে এসব ডিজে পার্টি।
তবে এসব ডিজে পার্টিকে পুরান ঢাকার অনেকে আবার অপসংস্কৃতি বলে মনে করেন। তাদের মত পুরান ঢাকায় তারা আগেও ঘুড়ি উৎসব (সাকরাইন) করতেন। তখন ডিজেপার্টি, নাইটপার্টির আয়োজন ছিল না। এখন ডিজেপার্টির নামে কোথাও কোথাও মদ্য পানের ব্যবস্থাও হচ্ছে যা সাকরাইনের মুল থিমের সঙ্গে যায় না।
অনেকের মতে এটি এখন যে আঙ্গিকে পালিত হয়, তা কিছুটা ইংরেজি নববর্ষের উদযাপনাকেই মনে করিয়ে দেয়। তারপরও উৎসব বলে কথা। এই যান্ত্রিক জীবনে একটা দিন যদি সাকরাইন উৎসবের নামেও মেতে ওঠা যায় মন্দ কি। কারণ যে কোনও উৎসবই মানুষের মিলনের আনন্দ বার্তা বয়ে আনে। এটি উদযাপন করতে নতুন ঢাকা থেকেও পরিচিত আত্নীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবরা ছুটে যান পুরান ঢাকায়।
তাছাড়া এই পৌষ সংক্রান্তির দিনে বাঙ্গালির পছন্দের পিঠে, পুলি, পায়েস কিংবা মোঘলাই ঘরানার খানাপিনা তেহারি, বিরিয়ানি, কাবাব ইত্যাদি দিয়ে রসনাতৃপ্তির আয়োজনও থাকে। পুরান ঢাকায় যাদের বাড়ি, তারা নতুন ঢাকায় থাকা তাদের আত্নীয় স্বজনদেরও এদিন দাওয়াত করে থাকেন। তাই সব মিলিয়ে সাকরাইন এর ইতিহাস যাই হোক, বাস্তবে এটি বড় এক উৎসব।