শৈশবে আমরা ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী ব্রজেন দাসের (৯ ডিসেম্বর ১৯২৭ – ১ জুন ১৯৯৮) কথা শুনেছি। বাংলাদেশের অন্যতম সেরা এই সাঁতারু ১৯৫৮ সালের ১৮ আগস্ট ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডকে বিভক্ত করা ৬৭.৫ কিলোমিটার দুরত্বের ইংলিশ চ্যানেলটি সাতরিয়ে পার হওয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় তিনিই হলেন ইংলিশ চ্যানেল জয়ী প্রথম এশিয়। ব্রজেন দাস ১৯৫৮, ১৯৫৯, ১৯৬০, ১৯৬১ সালে সর্বমোট ছয়বার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেন। ১৯৬১ সালে ১০ ঘণ্টা ৩৫ মিনিটে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েছিলেন তিনি।
এখন আর দেশের কারোর ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়ার কথা শোনা যায় না। তবে হালে বাংলাদেশের দুরপাল্লার সাঁতারুদের কাছে আকর্ষণ হয়ে এসেছে বাংলা চ্যানেল। এটি হলো টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিমপাড়া সমুদ্রসৈকত থেকে শুরু করে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের উত্তর সৈকত পর্যন্ত ১৬.১ কিলোমিটার সাঁতরানো। এবারের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩। এতে বিজয়ী হন সাইফুল ইসলাম রাসেল।
বাংলা চ্যানেলে এবার দুজন নারীসহ ৪৩ জন অংশ নিয়ে ৪২ জনই সফল হন। দুই নারীর একজন ভারতের রচনা শর্মা এবং অপরজন বাংলাদেশের শোহাগী আক্তার। শোহাগী আক্তার ৪ ঘণ্টা ২৬ মিনিটে এবং রচনা শর্মা ৫ ঘণ্টা সময় নিয়ে চ্যানেলটি পাড়ি দিয়েছেন। প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন ঢাকার উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সাইফুল ইসলাম রাসেল। দ্বিতীয় হয়েছেন ইলিয়াস হোসেন। তিনি সময় নেন ৪ ঘণ্টা ৪ মিনিট। তাঁর চাইতে ৭ মিনিট বেশি সময়ে সাঁতরিয়ে তৃতীয় হয়েছেন মো. মনিরুজ্জামান।
সাইফুল ইসলাম রাসেল টানা তৃতীয়বারের মতো বাংলা চ্যানেলে বিজয়ী হলেন। চ্যানেলটি পাড়ি দিতে তার সময় লেগেছে ৩ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট। রাসেল এ বছর থাইল্যান্ডের ফুকেটে অনুষ্ঠিত ওশেনম্যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সপ্তম হন। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইমিংপুলের ট্রেনার হিসেবে কাজ করছেন এই সাঁতারু।
সাঁতারুদের মধ্যে ছয় ঘণ্টার মতো সময় নিয়ে চ্যানেলটি পেরিয়েছেন ফজলে রাব্বি চৌধুরী, মোহাম্মদ তামিম পারভেজ ও মুশা আহমেদ। দুজন প্রতিযোগি অবশ্য সাঁতার শেষ করতে পারেননি। তাঁরা হলেন ফজলুল কবির সিনা ও মাহমুদুর রহমান। আন্তর্জাতিক রীতি মেনে এই সাঁতারের আয়োজন করা হয়েছে। নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল। সবার জন্য আলাদা করে নৌকা ও উদ্ধারকর্মী ছিল। আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফার ও স্কুবা ডাইভার অকাল প্রয়াত কাজী হামিদুল হক এই বাংলা চ্যানেলে সাঁতরানোর প্রবর্তক । ২০০৬ সালে প্রথমবার এই সাঁতার অনুষ্ঠিত হয়। সেবার এতে অংশ নিয়েছিলেন লিপটন সরকার, ফজলুল কবির সিনা ও সালমান সাইদ।
বাংলাদেশকে বিশ্বে পরিচিত করে তুলতে এবং মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে বাংলা চ্যানেলে প্রতি বছর সাঁতারের আয়োজন করে ষড়জ অ্যাডভেঞ্চার। এই সাতারের প্রধান সমন্বয়ক ও ষড়জ অ্যাডভেঞ্চারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লিপটন সরকারের আছে ২০ বার চ্যানেলটি পাড়ি দেওয়ার একক রেকর্ড। বাংলা চ্যানেল এর প্রথম আসরের সাঁতারেও অংশ নিয়েছিলেন লিপটন সরকার, সাথে ছিলেন ফজলুল কবির সিনা ও সালমান সাইদ। লিপটন সরকার ২০১২ সালে দুবার সাঁতরে পার হয়েছেন এই চ্যানেল। এবারের আসরে তিনি সময় নেন ৫ ঘণ্টা ২৬ মিনিট।
এবারের আয়োজনের সাঁতারুরা হলেন ফজলুল কবির সিনা, লিপটন সরকার, মো. মনিরুজ্জামান, আয়রনম্যান খ্যাত মোহাম্মদ শামসুজ্জামান আরাফাত, শেখ মাহবুব উর রহমান, আল্লামা দিদার, সালাহ উদ্দিন, মো. কামাল হোসেন, জিহাদ হুসেন, আবাদুল ইসলাম, ইলিয়াস হোসেন, মাহাদী হাসান, আবদুল্লাহ আল সাবিত, এস এম শারিয়ার মাহমুদ, হুমায়েদ ইছাহাক মুন, রচনা শর্মা, আতিকুল ইসলাম, ফজলে রাব্বি চৌধুরী, আবদুল মতিন, জয়তু দাস, মইজ উদ্দিন, ফরিদ আহমেদ খান, মোহাম্মদ তামিম পারভেজ, মুরাদ হোসেন, গোলাম হাফিজ, সবুজ কুমার বর্মণ, নাদিম মাহমুদ, মাহমুদুল হাসান, হাসান ইমাম, জামিল হোসেন, জাফর সাদেক, সৌরভ সমাদ্দার, মুশা আহমেদ, নাসির উদ্দিন, মাহমুদুর রহমান, সাইফুল ইসলাম, আবুল্লাহ আল রোমান, সুমন বালা, ফারুক হোসেন, এম এস টি শোহাগী আক্তার, মো. নাজমুজ সাকিব, আব্দুল ইলা ও উজ্জ্বল চৌধুরী।
পাবনার সাথিয়ার সাঁতারু জামিল হোসেন চার ঘন্টা ৪৩ মিনিটে বাংলা চ্যানেল পার হন। তিনি এর আগে পদ্মায় ২০ কিলোমিটার, যমুনায় ৩৫ কিলোমিটার ও সুরমায় ৪৫ কিলোমিটার দুরপাল্লার সাঁতার কেটেছেন।
ইংলিশ চ্যানেল এর দুরত্ব, চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকুলতা বিবেচনায় বাংলা চ্যানেল কিছুই নয়। তারপরও দেশের সাঁতারের পরিমন্ডলে এটিই হলো দুরপাল্লার বিবেচনায় কঠিন চ্যালেঞ্জ। কিছু সাহসী মানুষ প্রতি বছর বাংলা চ্যানেল পার হচ্ছেন, এটাও কম কি?