ছবির মতো এই দেশে

0
73
আবহমান বাংলাদেশের সবুজ শ্যামল প্রান্তর।
আবহমান বাংলাদেশের সবুজ শ্যামল প্রান্তর।

তখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর জন্ম হয়নি। এমনকি টেলিভিশনও অতটা সহজলভ্য ছিল না। সঙ্গত কারণে আজ দেশের আনাচে কানাচে আবিষ্কৃত নিত্য নতুন ভ্রমণ স্পটগুলোর যে অপরুপ ছবি আমরা দেখি ছবির মতো এই দেশে, তা দেখার সৌভাগ্য হয়নি কবি, নাট্যকার ও সংগীতস্রষ্টা দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩) কিংবা অকাল প্রয়াত কবি, গীতিকার ও অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল (১৯৩৬-১৯৮৯) এর।

তারপরও নিজের গোচরীভূত সৌন্দর‌্য দেখেই দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লিখেছিলেন এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। অপরদিকে অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল তার বিখ্যাত কবিতা ‘ছবি’তে বলেছিলেন,

আপনাদের সবার জন্যে এই উদার আমন্ত্রণ
ছবির মতো এই দেশে একবার বেড়িয়ে যান।


অবশ্য উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো মনোহারী স্পট আমাদের নেই,
কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না- আপনাদের স্ফীত সঞ্চয় থেকে
উপচে পড়া ডলার, মার্ক কিংবা স্টার্লিঙের বিনিময়ে যা পাবেন
ডালাস অথবা মেম্ফিস অথবা ক্যালিফোর্নিয়া তার তুলনায় শিশুতোষ!

আসুন, ছবির মতো এই দেশে বেড়িয়ে যান
রঙের এমন ব্যবহার বিষয়ের এমন তীব্রতা
আপনি কোনো শিল্পীর কাজে পাবেন না, বস্তুত শিল্প মানেই নকল
নয় কি?

অথচ দেখুন, এই বিশাল ছবির জন্যে ব্যবহৃত সব উপকরণ
অকৃত্রিম;
আপনাকে আরো খুলে বলি; এটা, অর্থাৎ আমাদের এই দেশ,
এবং আমি যার পর্যটন দপ্তরের অন্যতম প্রধান, আপনাদের খুলেই বলি,
সম্পূর্ণ নতুন একটি ছবির মতো করে
সম্প্রতি সাজানো হয়েছে।

খাঁটি আর্যবংশসম্ভূত শিল্পীর কঠোর তত্ত্বাবধানে ত্রিশ লক্ষ কারিগর
দীর্ঘ ন’টি মাস দিনরাত পরিশ্রম করে বানিয়েছেন এই ছবি।
এখনো অনেক জায়গায় রং কাঁচা- কিন্তু কী আশ্চর্য গাঢ় দেখেছেন?
ভ্যান গগ্- যিনি আকাশ থেকে নীল আর শস্য থেকে
সোনালী তুলে এনে
ব্যবহার করতেন কখনো, শপথ করে বলতে পারি,
এমন গাঢ়তা দেখেন নি!

আর দেখুন, এই যে নরমুন্ডের ক্রমাগত ব্যবহার- ওর ভেতরেও
একটা গভীর সাজেশান আছে- আসলে ওটাই এই ছবির অর্থাৎ
এই ছবির মতো দেশের- থিম্ ।

১৯৮৯ সালে পরলোকগত এই রোমান্টিক কবি নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশকে মহান শিল্পীর তুলিতে আঁকা একটি কালজয়ী ছবি হিসেবে কল্পনা করেছেন। অথচ তখন তার সামনে ছিল না সাজেক কিংবা বান্দরবনের থানচির মনোলোভা সৌন্দরর‌্য। ধারণা করি দক্ষিণের সমুদ্র, নদীমাতৃক অববাহিকা, রাঙ্গামাটির হৃদ, সিলেটের চা বাগানের মতো সহজলভ্য ভ্রমণ কেন্দ্রগুলো দেখেই তিনি এ কবিতাটি লেখেন। নিপুণ শব্দের বর্ণনায় তিনি জানান দেন ৩০ লক্ষ খাঁটি বাঙালি-শিল্পী তথা শহিদের দীর্ঘ নয় মাসের শ্রমে-আত্মদানে সৃজিত হয়েছে এই ছবি। তাঁর নিশ্চিত ধারণা, রঙের জাদুকর শিল্পী ভ্যান গগও এমন রঙের আশ্চর্য গাঢ়তা কখনো দেখেননি।

কবি অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল মুলত বিদেশীদের আমন্ত্রন জানালেও বাস্তবতা হলো বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এখনো নিজের দেশটাকেই ঠিকমতো দেখে উঠতে পারেননি। আবার কবি যখন এই কবিতা লিখেছিলেন, যুদ্ধোত্তর সেই সময়ে আমাদের বেড়ানোর জায়গাগুলো অতটা উম্মোচিত হয়নি। বিশেষ করে পার্বত্য তিন জেলা এবং দক্ষিণের সমুদ্র ঘেষা তটরেখাগুলোর। সত্য বটে হালে ভ্রমণপিপাসু মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম অনেক ঘুরছে। কিন্তু পর‌্যটনের জন্য বিখ্যাত দেশগুলোর তুলনায় আমাদের সরকারী ব্যবস্থাপনা ও উদ্যোগ সীমিত। তাই দেশী ভ্রমণপিপাসুদের সমস্যা না হলেও এক সুন্দরবন ছাড়া বিদেশীরা সেভাবে আসছে না।

অথচ কে না জানে অবকাঠামো গড়ে তোলা গেলে আমাদের ভ্রমণ সম্ভাবনাও অপার। আর তখনই স্বার্থক হবে দুই কবির বর্ণনায় উঠে আসা এদেশের রুপ বৈচিত্র।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here